পাতলা পায়খানা হলে কি কি খাবার খাওয়া যাবে না তা জেনে শরীর সুস্থ রাখুন। সঠিক খাবার আপনার দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক।
Key Takeaways:
ভাজা-পোড়া খাবার ও ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন।
দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকুন।
অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার বাদ দিন।
মিষ্টি জাতীয় পানীয় ও খাবার পরিহার করুন।
কোমল পানীয় ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় পান করবেন না।
ফল ও সবজির খোসা না ছাড়িয়ে খাবেন না।
আপনারা অনেকেই হয়তো পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছেন। এটি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা, যা আমাদের জীবনযাত্রায় ব্যঘাত ঘটাতে পারে। যখন পেট খারাপ হয়, তখন কি খাওয়া উচিত আর কি উচিত নয়, তা নিয়ে আমরা প্রায়শই দ্বিধায় ভুগি। সঠিক খাবার নির্বাচন একদিকে যেমন আমাদের দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্য করে, তেমনি কিছু খাবার আছে যা এই অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। আজকের এই article-এ আমরা সহজভাবে আলোচনা করব, পাতলা পায়খানা হলে কি কি খাবার খাওয়া যাবে না, যাতে আপনি দ্রুত সুস্থ হয়ে উঠতে পারেন।
Table of Contents
পাতলা পায়খানা বা ডায়রিয়া কেন হয়?
পাতলা পায়খানা, যা ডায়রিয়া নামেও পরিচিত, এটি একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। সাধারণত এটি কোনো ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা পরজীবী দ্বারা পেটের সংক্রমণ (gastrointestinal infection) থেকে হয়। এছাড়া, অস্বাস্থ্যকর খাবার, পানি, অতিরিক্ত তেল-মসলাযুক্ত খাবার, অনেক সময় ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বা কিছু বিশেষ রোগের কারণেও ডায়রিয়া হতে পারে। যখন আমাদের পরিপাকতন্ত্রে (digestive system) কোনো সমস্যা হয়, তখন শরীর দ্রুত পানি ও পুষ্টি বের করে দিতে চায়, যার ফলে পাতলা পায়খানা হয়।
পাতলা পায়খানা হলে কি কি খাবার খাওয়া যাবে না?
ডায়রিয়ার সময় শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং জলশূন্যতা দেখা দিতে পারে। এই সময় কিছু নির্দিষ্ট খাবার আছে যা আমাদের পরিপাকতন্ত্রের উপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ডায়রিয়াকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এই খাবারগুলো এড়িয়ে চললে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়। নিচে এমন কিছু খাবারের তালিকা দেওয়া হলো যা পাতলা পায়খানা হলে একেবারেই খাওয়া উচিত নয়।
১. ভাজা-পোড়া ও ফাস্ট ফুড
ভাজা-পোড়া খাবার, যেমন – সিঙ্গারা, সমুচা, আলুর চিপস, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, পুরি, বা বিভিন্ন ধরনের ভাজা নাস্তায় প্রচুর পরিমাণে তেল থাকে। এই তেল আমাদের হজমতন্ত্রের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর, বিশেষ করে যখন এটি দুর্বল থাকে। তেলযুক্ত খাবার হজম হতে বেশি সময় নেয় এবং এটি অন্ত্রের (intestine) চলাচলকে বাড়িয়ে দিতে পারে, যা ডায়রিয়াকে আরও তীব্র করে। ফাস্ট ফুড, যেমন – বার্গার, পিৎজা, ফ্রায়েড চিকেন ইত্যাদিও এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত।
প্রো টিপ: ডায়রিয়ার সময় তেল-মসলা কম এবং সহজে হজম হয় এমন খাবার খান। যেমন, ভাতের মাড়, জাউভাত, সেদ্ধ সবজি ভালো।
২. দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
অনেকেরই ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স (lactose intolerance) থাকে, অর্থাৎ তারা দুধের মধ্যে থাকা ল্যাকটোজ নামক শর্করা হজম করতে পারেন না। ডায়রিয়ার সময় আমাদের পরিপাকতন্ত্র এমনিতেই দুর্বল থাকে, তখন দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার, যেমন – দুধ, দই, পনির, ঘি, মাখন খেলে ল্যাকটোজ হজম করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। এর ফলে পেট ফাঁপা, গ্যাস এবং পাতলা পায়খানা বেড়ে যেতে পারে। তাই ডায়রিয়ার সময় দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার এড়িয়ে চলাই ভালো।
৩. অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার
ঝাল, মশলাযুক্ত খাবার আমাদের হজম প্রক্রিয়াকে উত্তেজিত করে। কাঁচা মরিচ, গোলমরিচ, গরম মশলা (এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি), এবং অন্যান্য তীব্র মশলা পেটে জ্বালাপোড়া সৃষ্টি করতে পারে এবং অন্ত্রের নড়াচড়া বাড়িয়ে দিতে পারে। যখন ডায়রিয়া হয়, তখন পরিপাকতন্ত্রকে শান্ত রাখা প্রয়োজন। তাই এই সময়ে যেকোনো ধরনের অতিরিক্ত মসলাযুক্ত খাবার, কারি, বা মশলাদার সস পরিহার করা উচিত।
৪. মিষ্টি জাতীয় পানীয় ও খাবার
অতিরিক্ত চিনিযুক্ত খাবার এবং পানীয় (যেমন – চকলেট, ক্যান্ডি, কেক, মিষ্টি বিস্কুট) ডায়রিয়ার সময় খাওয়া উচিত নয়। চিনি, বিশেষ করে উচ্চ ফ্রুক্টোজ কর্ন সিরাপ (high-fructose corn syrup) যুক্ত খাবার, অন্ত্রে পানি টেনে আনে এবং ডায়রিয়া বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া, মিষ্টি খাবারগুলো হজম হতেও সমস্যা তৈরি করতে পারে।
৫. কোমল পানীয় ও ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
কোমল পানীয় (soft drinks, soda) এবং ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়, যেমন – চা, কফি, কোলা ডায়রিয়ার সময় একেবারেই বর্জন করা উচিত। এই পানীয়গুলোতে থাকা ক্যাফেইন এবং চিনি অন্ত্রের গতি বাড়িয়ে দেয় এবং শরীরকে আরও জলশূন্য করে তুলতে পারে। এছাড়া, কার্বনেটেড (carbonated) পানীয় গ্যাস তৈরি করে পেট ফাঁপা বাড়াতে পারে।
৬. ফল ও সবজির খোসা yö/বা কাঁচা অবস্থায়
কিছু ফল ও সবজি, বিশেষ করে যাদের ফাইবার (fiber) বেশি, সেগুলো ডায়রিয়ার সময় হজম করা কঠিন হতে পারে। যেমন – কাঁচা আপেল, কাঁচা পেঁচি, কাঁচা পেঁপে, কাঁচা টমেটো। এছাড়ো, ফলের খোসা এবং সবজির শক্ত আঁশও হজমে সমস্যা করে। এগুলি খেলে পেটে ব্যথা বা ডায়রিয়া বাড়তে পারে। যদি ফল বা সবজি খেতে চান, তবে সেদ্ধ করে নরম করে খান এবং খোসা ফেলে দিন।
পাতলা পায়খানা হলে কোন খাবারগুলো খাওয়া যেতে পারে?
কোন খাবারগুলো খাওয়া যাবে না, তা জানার পাশাপাশি কোন খাবারগুলো খেলে দ্রুত সুস্থ হওয়া যায়, সেটাও জানা খুব জরুরি। সহজপাচ্য এবং শরীরকে জল সরবরাহ করে এমন খাবার ডায়রিয়ার সময় খুবই উপকারী।
পানি ও অন্যান্য তরল: ডায়রিয়ার প্রধান সমস্যা হলো শরীর থেকে পানি কমে যাওয়া। তাই পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি, ওরস্যালাইন (ORS), ডাবের পানি, হালকা গরম স্যুপ পান করা উচিত।
ভাত ও ভাতের মাড়: সাদা ভাত বা জাউভাত (rice porridge) খুবই সহজপাচ্য। ভাতের মাড়েও অনেক পুষ্টি থাকে যা এই সময় কাজে আসে।
কলা: পাকা কলা পটাসিয়ামের একটি ভালো উৎস, যা ডায়রিয়ার সময় শরীর থেকে বেরিয়ে যায়। এটি সহজপাচ্য এবং পেটের জন্য আরামদায়ক।
আপেল সস: খোসা ছাড়ানো আপেল সেদ্ধ করে বা রান্না করে খেলে তা হজম করা সহজ হয় এবং এটি পেট পরিষ্কার করতেও সাহায্য করে।
সেদ্ধ আলুর ভর্তা: সেদ্ধ আলু, বিশেষ করে খোসা ছাড়িয়ে ভর্তা করে খেলে তা সহজপাচ্য হয় এবং শক্তি যোগায়।
দই (কিছু ক্ষেত্রে): যদি ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স না থাকে, তবে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ দই (yogurt) অন্ত্রের ভালো ব্যাকটেরিয়া ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করতে পারে। তবে এটি সাবধানে এবং অল্প পরিমাণে শুরু করা উচিত।
একটি তুলনামূলক সারণী: পাতলা পায়খানা হলে যা খাবেন বনাম যা খাবেন না
নিচের সারণীতে কিছু সাধারণ খাবারের তালিকা দেওয়া হলো, যা পাতলা পায়খানা হলে খাওয়া যেতে পারে এবং যা এড়িয়ে চলা উচিত।
| খাওয়া যাবে (Eat) | খাওয়া যাবে না (Avoid) |
| :———————————————– | :———————————————————- |
| তরল: জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল, পাতলা স্যুপ | পানীয়: কোমল পানীয়, চা, কফি, ফলের রসের পানীয় |
| শস্য: সাদা ভাত, জাউভাত, সেদ্ধ রুটি | শস্য: লাল চালের ভাত, আস্ত শস্যের রুটি, ওটস (প্রথমে কম) |
| ফল: পাকা কলা, আপেল সস | ফল: কাঁচা ফল, টক ফল, বেরি জাতীয় ফল (প্রথমে কম) |
| সবজি: সেদ্ধ আলু, সেদ্ধ গাজর, মিষ্টি কুমড়া | সবজি: কাঁচা সবজি, শিম, মটরশুঁটি, ব্রকলি, ফুলকপি |
| অন্যান্য: সেদ্ধ ডিম, চিকেন স্যুপ (কম তেল-মসলা) | অন্যান্য: ভাজা-পোড়া খাবার, ফাস্ট ফুড, চর্বিযুক্ত মাংস, ডেইরি |
ডায়রিয়ার সময় কখন ডাক্তারের পরামর্শ নেবেন?
সাধারণত ডায়রিয়া কয়েক দিনের মধ্যেই সেরে যায়। তবে কিছু ক্ষেত্রে এটি গুরুতর হতে পারে এবং ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া অত্যাবশ্যক।
যদি ডায়রিয়া ৪৮ ঘন্টার বেশি স্থায়ী হয়।
যদি মলের সাথে রক্ত বা পুঁজ বের হয়।
যদি তীব্র পেট ব্যথা থাকে।
যদি জ্বর খুব বেশি হয় (১০২°F এর উপরে)।
যদি জলশূন্যতার লক্ষণ দেখা দেয়, যেমন – মুখ শুকিয়ে যাওয়া, প্রস্রাব কমে যাওয়া, দুর্বলতা।
শিশুদের বা বয়স্কদের ডায়রিয়া হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
প্রশ্ন ১: পাতলা পায়খানা হলে কি টক জাতীয় ফল খাওয়া যাবে?
উত্তর: পাতলা পায়খানা হলে টক জাতীয় ফল, যেমন – কমলা, আপেল, আঙুর ইত্যাদি এড়িয়ে চলাই ভালো। এগুলোতে থাকা অ্যাসিডিটি (acidity) এবং ফাইবার হজমে সমস্যা করতে পারে। তবে পাকা কলা বা আপেল সস খাওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ২: ডায়রিয়া হলে কি দই খাওয়া নিরাপদ?
উত্তর: কিছু ডায়রিয়ার ক্ষেত্রে প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ দই উপকারী হতে পারে। তবে যদি আপনার ল্যাকটোজ ইন্টলারেন্স থাকে বা দই খেলে সমস্যা বাড়ে, তবে এটি এড়িয়ে চলুন।
প্রশ্ন ৩: ওরস্যালাইন (ORS) কখন পান করা উচিত?
উত্তর: যখনই পাতলা পায়খানা হবে, শরীর থেকে জল ও লবণ বেরিয়ে যাওয়ার সময়েই ওরস্যালাইন পান করা উচিত। এটি জলশূন্যতা রোধে সবচেয়ে কার্যকরী।
প্রশ্ন ৪: শিশুর পাতলা পায়খানা হলে কি খাবার দেওয়া উচিত?
উত্তর: শিশুদের ক্ষেত্রে মায়ের দুধ (যদি বুকের দুধ খায়) বা ওরস্যালাইন সবচেয়ে জরুরি। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে স্বাভাবিক খাবারের পাশাপাশি সহজপাচ্য খাবার, যেমন – ভাতের মাড়, পাতলা জাউ, সেদ্ধ আলুর ভর্তা অল্প পরিমাণে দেওয়া যেতে পারে।
প্রশ্ন ৫: ডায়রিয়ার সময় চা বা কফি পান করা কি ঠিক?
উত্তর: না, ডায়রিয়ার সময় চা বা কফি পান করা উচিত নয়। এগুলোতে থাকা ক্যাফেইন শরীরকে আরও জলশূন্য করে তোলে এবং অন্ত্রের গতি বাড়িয়ে দেয়।
প্রশ্ন ৬: পাতলা পায়খানা হলে কত দিন পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক খাবার খেতে পারব না?
উত্তর: এটি নির্ভর করে ডায়রিয়ার তীব্রতার উপর। সাধারণত, ডায়রিয়া শুরু হওয়ার পর প্রথম ২৪-৪৮ ঘন্টা সহজপাচ্য খাবার খাওয়া উচিত। ধীরে ধীরে শরীর সুস্থ হলে স্বাভাবিক খাবারে ফেরা যেতে পারে, তবে ভাজা-পোড়া ও মসলাযুক্ত খাবার কিছুদিন বাদ রাখাই ভালো।
প্রশ্ন ৭: ডায়রিয়া থেকে মুক্তি পেতে ঘরোয়া টোটকা কি আছে?
উত্তর: সহজপাচ্য খাবার, পর্যাপ্ত জল পান, ওরস্যালাইন, এবং আদা চা (কিছু ক্ষেত্রে) ঘরোয়া টোটকা হিসেবে কাজ করতে পারে। তবে গুরুতর অবস্থায় অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
উপসংহার
পাতলা পায়খানা একটি সাময়িক সমস্যা হলেও, সঠিক খাদ্যাভ্যাস আপনাকে দ্রুত আরোগ্য লাভে সাহায্য করবে। কোন খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে এবং কোনগুলো আপনার শরীরকে শক্তি যোগাবে, তা জেনে রাখলে এই সময়টি আপনি সহজেই পার করতে পারবেন। মনে রাখবেন, শরীরকে বিশ্রাম দেওয়া এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে জল ও প্রয়োজনীয় পুষ্টি গ্রহণ করাই হলো পাতলা পায়খানা থেকে সেরে ওঠার মূল চাবিকাঠি। আপনার সুস্বাস্থ্য কামনা করি।