জন্ডিস হওয়াটা একটু চিন্তার কারণ হতে পারে। যখন ত্বক এবং চোখের সাদা অংশ হলুদ দেখা যায়, তখন অনেকেই ঘাবড়ে যান। কিন্তু ভয় পাবেন না, অনেকেই এই সমস্যায় পড়েন এবং সঠিক যত্নে এটি দ্রুত সেরে যায়। আজকের আলোচনায় আমরা জন্ডিসের কারণ, লক্ষণ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, কী ধরনের ঔষধ ও ঘরোয়া প্রতিকার গ্রহণ করা যেতে পারে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। আমরা ধাপে ধাপে এই রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়গুলো বুঝিয়ে দেব, যাতে আপনি সহজেই নিজের যত্ন নিতে পারেন।
Table of Contents
জন্ডিস কী এবং কেন হয়?
জন্ডিস বা আইটেরাস (Icterus) হলো এমন একটি অবস্থা যেখানে রক্তে বিলিরুবিনের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। বিলিরুবিন হলো একটি হলুদ রঙের রঞ্জক পদার্থ যা লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার সময় তৈরি হয়। লিভার বা যকৃৎ এই বিলিরুবিনকে প্রক্রিয়াজাত করে পিত্তরসের সাথে মিশিয়ে শরীর থেকে বের করে দেয়। কিন্তু যখন লিভার ঠিকমতো কাজ করতে পারে না বা বিলিরুবিন শরীর থেকে বের হতে বাধা পায়, তখন এটি রক্তে জমা হতে শুরু করে এবং শরীর হলুদ দেখাতে শুরু করে।
জন্ডিসের প্রধান কারণসমূহ:
- ভাইরাল হেপাটাইটিস (Viral Hepatitis): হেপাটাইটিস এ, বি, সি, ডি, ই ভাইরাস লিভারে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যা বিলিরুবিন প্রক্রিয়াজাতকরণে বাধা দেয়।
- অ্যালকোহল জনিত লিভার রোগ (Alcohol-related Liver Disease): অতিরিক্ত মদ্যপান লিভারের মারাত্মক ক্ষতি করে, যা জন্ডিসের কারণ হতে পারে।
- অটোইমিউন হেপাটাইটিস (Autoimmune Hepatitis): যখন শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা লিভারকে আক্রমণ করে, তখন এটি ঘটে।
- ড্রাগ-প্ররোচিত লিভার ইনজুরি (Drug-induced Liver Injury): কিছু ঔষধ, বিশেষ করে প্যারাসিটামল অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
- সিরোসিস (Cirrhosis): দীর্ঘস্থায়ী লিভারের রোগ যা লিভারকে শক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত করে।
- পিত্তনালীর বাধা (Bile Duct Obstruction): পিত্তপাথর (gallstones) বা টিউমারের কারণে পিত্তরস বের হতে না পারলে বিলিরুবিন রক্তে জমা হয়।
- হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া (Hemolytic Anemia): যখন লোহিত রক্তকণিকা স্বাভাবিকের চেয়ে দ্রুত ভেঙে যায়, তখন বিলিরুবিনের পরিমাণ বেড়ে যায়।
- নবজাতকের জন্ডিস (Neonatal Jaundice): অনেক নবজাতকের লিভার অপরিণত থাকার কারণে বিলিরুবিন প্রক্রিয়াজাত করতে সমস্যা হয়, যা সাধারণত অল্প দিনেই সেরে যায়।
জন্ডিসের লক্ষণগুলো কী কী?
জন্ডিসের সবচেয়ে পরিচিত লক্ষণ হলো শরীরের হলুদাভ ভাব। তবে এর বাইরেও কিছু সাধারণ লক্ষণ দেখা যায়:
- ত্বক ও চোখের সাদা অংশে হলুদ রং: এটিই প্রধান লক্ষণ।
- গাঢ় রঙের প্রস্রাব: চায়ের মতো বা গাঢ় হলুদ রঙের প্রস্রাব হতে পারে।
- ফ্যাকাশে রঙের মল: পিত্তরস মলের সাথে মিশতে না পারলে মল ফ্যাকাশে বা সাদাটে হতে পারে।
- পেটে ব্যথা বা ফোলা: বিশেষ করে লিভার বা পেটের উপরের ডান দিকে ব্যথা।
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা: সব সময় ক্লান্ত বোধ করা।
- বমি বমি ভাব বা বমি হওয়া: হজমে সমস্যা হতে পারে।
- খাবারে অরুচি: কোনো কিছুই খেতে ইচ্ছা না করা।
- ওজন কমে যাওয়া: কারণ ছাড়াই ওজন কমতে পারে।
- পেটে জল জমা (Ascites): গুরুতর ক্ষেত্রে পেটে পানি জমতে পারে।
- চুলকানি: ত্বকে চুলকানি হতে পারে।
জন্ডিস হলে কি ঔষধ খেতে হবে?
জন্ডিসের চিকিৎসায় “একটি নির্দিষ্ট ঔষুুধ” বলে কিছু নেই, কারণ এর মূল কারণের উপর নির্ভর করে ঔষধ নির্বাচন করা হয়। এখানে কিছু সাধারণ ধরণের ঔষধ এবং চিকিৎসার কথা বলা হলো, যা চিকিৎসকের পরামর্শে ব্যবহার করা যেতে পারে:
১. কারণ অনুযায়ী ঔষধ:
জন্ডিসের কারণ যদি ভাইরাল হেপাটাইটিস হয়, তবে চিকিৎসক অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ দিতে পারেন। যদি পিত্তনালীতে কোনো বাধা থাকে, তবে তা অপসারণের জন্য সার্জারি বা এন্ডোস্কোপিক পদ্ধতি লাগতে পারে। লিভারের প্রদাহ কমাতে স্টেরয়েড জাতীয় ঔষধ ব্যবহার করা হতে পারে, তবে এটি সব ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
২. সহায়ক ঔষধ (Supportive Medications):
জন্ডিসে আক্রান্ত রোগীর শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং উপসর্গ কমাতে কিছু ঔষধ ব্যবহার করা হয়:
- ভিটামিন কে (Vitamin K): যদি রক্ত জমাট বাঁধার সমস্যা (coagulation problems) দেখা দেয়, ভিটামিন কে দেওয়া হতে পারে।
- হেপাটোপ্রোটেকটিভ ঔষধ (Hepatoprotective Medications): এই ঔষধগুলো লিভারকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। অনেক ভেষজ উপাদান সহ এগুলি পাওয়া যায়, যেমন – সিলিমারিন (Silymarin)।
- বমি ও বমি বমি ভাব কমানোর ঔষধ (Anti-emetics): যেমন – ওনডানসেট্রন (Ondansetron) বা মেট্রোক্লোপ্রামাইড (Metoclopramide)।
- চুলকানি কমানোর ঔষধ (Anti-pruritics): হিস্টামিন ব্লকার (Antihistamines) বা কোলাস্টিরামিন (Cholestyramine) চুলকানি কমাতে সাহায্য করতে পারে।
৩. অ্যান্টিবায়োটিক (Antibiotics):
যদি জন্ডিসের সাথে ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ (bacterial infection) থাকে, তবে চিকিৎসক অ্যান্টিবায়োটিক প্রেসক্রাইব করতে পারেন।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:
বিশেষ দ্রষ্টব্য: মনে রাখবেন, কোনো ঔষধই চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করা উচিত নয়। লিভার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, এবং ভুল ঔষধে এর আরও ক্ষতি হতে পারে। তাই, জন্ডিস ধরা পড়লে দ্রুত একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য।
জন্ডিস হলে ঘরোয়া প্রতিকার
ওষুধের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি জন্ডিস থেকে দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করতে পারে। এগুলো লিভারের উপর চাপ কমায় এবং শরীরকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সহায়ক।
১. পর্যাপ্ত বিশ্রাম
শরীরের যে কোনও সংক্রমণের সময় বিশ্রাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জন্ডিসে আক্রান্ত হলে লিভারকে সুস্থ হতে সময় দিন। অতিরিক্ত পরিশ্রম লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তাই পর্যাপ্ত ঘুম এবং আরাম নিশ্চিত করুন।
২. প্রচুর পরিমাণে জল পান
জল শরীরকে ডিহাইড্রেশন থেকে রক্ষা করে এবং বর্জ্য পদার্থ বের করে দিতে সাহায্য করে। দিনে অন্তত ৮-১০ গ্লাস জল পান করুন। এছাড়াও, ডাবের জল, ফলের রস (চিনি ছাড়া) পান করতে পারেন।
৩. স্বাস্থ্যকর খাবার
জন্ডিস হলে সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত।
খাবার তালিকায় যা রাখবেন:
- ফল: আপেল, নাশপাতি, কলা, আঙ্গুর, পেঁপে, তরমুজ।
- সবজি: সেদ্ধ করা বা হালকা ভাপানো সবজি যেমন – করলা, লাউ, পেঁপে, গাজর, বিট।
- শস্য: নরম ভাত, ওটস, ডালিয়া।
- প্রোটিন: কম ফ্যাটযুক্ত প্রোটিন যেমন – মাছ (বিশেষ করে হালকা রান্না করা), মুরগির মাংস (চামড়া ছাড়া)।
যা এড়িয়ে চলবেন:
- তেল ও মশলাদার খাবার: ভাজাভুজি, ফাস্ট ফুড, উচ্চ তেলযুক্ত খাবার লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করে।
- অ্যালকোহল ও ক্যাফেইন: চা, কফি এবং মদ্যপান সম্পূর্ণভাবে বর্জন করুন।
- প্রক্রিয়াজাত খাবার: প্যাকেটজাত খাবার, ক্যানড ফুড এড়িয়ে চলুন।
- অতিরিক্ত লবণ: খাদ্যতালিকায় লবণের পরিমাণ কমান।
৪. ভেষজ প্রতিকার
কিছু ভেষজ উপাদান জন্ডিসের চিকিৎসায় সহায়ক হতে পারে:
- করলা: করলার রস বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে এবং লিভারের কার্যকারিতা বাড়ায়। সকালে খালি পেটে করলার কাঁচা রস পান করতে পারেন। একটি গবেষণা অনুসারে, করলার কিছু উপাদান লিভার সুরক্ষায় কার্যকর।
- আমলকী: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ আমলকী লিভারের কার্যকারিতা উন্নত করে এবং শরীর থেকে টক্সিন বের করে দিতে সাহায্য করে।
- আদা: আদা হজমশক্তি বাড়াতে ও বমি ভাব কমাতে সহায়ক। আদা চা পান করতে পারেন।
- দারুচিনি: দারুচিনি লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে।
- তুলসী পাতা: তুলসী পাতা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং লিভারকে সুস্থ রাখতে ভূমিকা রাখে।
৫. সূর্যস্নান
বিশেষ করে নবজাতকের জন্ডিসের ক্ষেত্রে, সকালের হালকা সূর্যস্নান (সূর্যের প্রথম আলো) বিলিরুবিনের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে। তবে প্রাপ্তবয়স্কদের ক্ষেত্রে সরাসরি রোদ থেকে লিভারকে রক্ষা করাই ভালো।
খাবারের ধরন | গ্রহণযোগ্য খাবার | বর্জনীয় খাবার |
---|---|---|
ফল | আপেল, কলা, ডাবের জল, তরমুজ, পেঁপে | আম, শুকনো ফল, অতিরিক্ত মিষ্টি ফল |
সবজি | সেদ্ধ গাজর, বিট, লাউ, পেঁপে, ব্রকলি | ভাজা সবজি, মসলাযুক্ত সবজি, ফুলকপি |
শস্য | নরম ভাত, ওটস, রুটি (তেল ছাড়া) | ভাজা বা তেলযুক্ত রুটি, প্যাকেটজাত সিরিয়াল |
প্রোটিন | হালকা সেদ্ধ মাছ, মুরগির চামড়া ছাড়া মাংস, বিনস | লাল মাংস, ভাজা মাছ/মাংস, ডিমের কুসুম (অল্প পরিমাণে) |
পানীয় | প্রচুর জল, ডাবের জল, লেবুর শরবত (চিনি ছাড়া) | চা, কফি, অ্যালকোহল, কোমল পানীয় |
জন্ডিস নিরাময়ে জীবনযাত্রার পরিবর্তন
কেবল ঔষধ বা ঘরোয়া প্রতিকারই যথেষ্ট নয়, জন্ডিস থেকে মুক্তি পেতে এবং লিভারকে সুস্থ রাখতে কিছু জীবনযাত্রার পরিবর্তন আনা জরুরি। এই পরিবর্তনগুলো লিভারের উপর চাপ কমাতে এবং দ্রুত আরোগ্য লাভে সহায়ক হবে।
১. নিয়মিত শরীরচর্চা (হালকা)
যদিও জন্ডিসে আক্রান্ত অবস্থায় ভারী ব্যায়াম এড়িয়ে চলতে হয়, তবে চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে হালকা কিছু শরীরচর্চা যেমন – হাঁটা বা হালকা স্ট্রেচিং লিভারের কার্যকারিতা বাড়াতে এবং সামগ্রিকভাবে শরীরকে সতেজ রাখতে সাহায্য করতে পারে। তবে, যেকোনো নতুন ব্যায়াম শুরু করার আগে অবশ্যই ডাক্তারের সাথে কথা বলুন।
২. স্ট্রেস বা মানসিক চাপ কমানো
অতিরিক্ত মানসিক চাপ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল করে দেয় এবং লিভারের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই, এই সময়ে যতটা সম্ভব মানসিক চাপ মুক্ত থাকার চেষ্টা করুন।:
- ধ্যান
- যোগব্যায়াম
- গভীর শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম
- পছন্দের সঙ্গীত শোনা
- প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো
৩. পর্যাপ্ত ঘুম
শরীরকে সুস্থ রাখতে ও লিভারকে পুনরায় কার্যক্ষম করে তুলতে পর্যাপ্ত ঘুম অপরিহার্য। প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা নিরবচ্ছিন্ন ঘুম নিশ্চিত করুন।
৪. ধূমপান ও মদ্যপান ত্যাগ
যদি আপনি ধূমপান বা মদ্যপান করেন, তবে জন্ডিস হলে এটি সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করা আবশ্যক। এই দুটি অভ্যাস লিভারের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর এবং জন্ডিসকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে।
৫. টক্সিন এড়িয়ে চলা
পরিবেশ বা খাদ্যের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করা বিভিন্ন টক্সিন (বিষাক্ত পদার্থ) লিভারের উপর চাপ ফেলে। তাই, যতটা সম্ভব রাসায়নিকমুক্ত খাবার এবং পানীয় গ্রহণ করুন।
জন্ডিসের প্রকারভেদ ও চিকিৎসাগত পার্থক্য
জন্ডিসের কারণ ও প্রভাবের ভিত্তিতে একে প্রধানত তিন ভাগে ভাগ করা হয়। প্রত্যেক প্রকারের জন্য চিকিৎসা পদ্ধতি কিছুটা ভিন্ন হতে পারে:
১. প্রি-হেপাটিক জন্ডিস (Pre-hepatic Jaundice)
কারণ: লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়ার হার অনেক বেড়ে গেলে (যেমন – হেমোলাইটিক অ্যানিমিয়া)। এক্ষেত্রে লিভার সুস্থ থাকলেও অতিরিক্ত বিলিরুবিন প্রক্রিয়াজাত করতে পারে না।
চিকিৎসা: মূল কারণ, অর্থাৎ কেন লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাচ্ছে, তার চিকিৎসা করতে হবে। যেমন – অ্যানিমিয়ার চিকিৎসা, কিছু ঔষধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া বন্ধ করা ইত্যাদি।
২. হেপাটিক জন্ডিস (Hepatic Jaundice)
কারণ: লিভার নিজেই ক্ষতিগ্রস্ত হলে (যেমন – হেপাটাইটিস, সিরোসিস, লিভার ক্যান্সার)। এক্ষেত্রে লিভার বিলিরুবিন সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত বা নিষ্কাশন করতে পারে না।
চিকিৎসা: লিভারের প্রদাহ কমানো, লিভারকে সুস্থ করা এবং মূল কারণের চিকিৎসা। এর মধ্যে অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ, স্টেরয়েড (প্রয়োজনে), ডিটক্সিফিকেশন থেরাপি ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
৩. পোস্ট-হেপাটিক জন্ডিস (Post-hepatic Jaundice)
কারণ: লিভার থেকে পিত্তনালী বা অন্ত্রে বিলিরুবিন পৌঁছানোর পথে কোনো বাধা থাকলে (যেমন – পিত্তপাথর, টিউমার)। এর ফলে বিলিরুবিন রক্তে ফিরে আসে।
চিকিৎসা: বাধার কারণটি অপসারণ করা। এটি এন্ডোস্কোপি (ERCP) বা সার্জারির মাধ্যমে করা হতে পারে।
জন্ডিসের প্রকার | প্রধান কারণ | চিকিৎসা পদ্ধতি |
---|---|---|
প্রি-হেপাটিক (Pre-hepatic) | লোহিত রক্তকণিকা ভেঙে যাওয়া (Hemorrhage) | মূল কারণের চিকিৎসা, রক্ত সঞ্চালন (যদি প্রয়োজন হয়) |
হেপাটিক (Hepatic) | লিভারের রোগ (হেপাটাইটিস, সিরোসিস) | লিভার সুস্থ রাখা, অ্যান্টিভাইরাল, অ্যান্টিবায়োটিক, ডিটক্সিফিকেশন |
পোস্ট-হেপাটিক (Post-hepatic) | পিত্তনালীর বাধা (Gallstones, Tumors) | বাধা দূরীকরণ (সার্জারি, এন্ডোস্কোপি) |
কখন ডাক্তারের শরণাপন্ন হবেন?
যদিও কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং বিশ্রাম জন্ডিস নিরাময়ে সাহায্য করতে পারে, তবে কিছু লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করা উচিত।
- যদি জন্ডিসের লক্ষণগুলো এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে থাকে বা আরও খারাপ হতে থাকে।
- যদি পেটে তীব্র ব্যথা, জ্বর, বমি বা রক্তপাত হয়।
- যদি মল একেবারেই ফ্যাকাশে বা সাদা হয়ে যায়।
- যদি ত্বকের চুলকানি অসহ্য হয়ে ওঠে।
- যদি আপনি লিভারের রোগের পারিবারিক ইতিহাস থাকে।
বিশেষ করে নবজাতকদের জন্ডিসকে কখনোই অবহেলা করা উচিত নয়। অল্প সময়ের মধ্যেই ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া জরুরি।
আপনি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) থেকে হেপাটাইটিস বি সম্পর্কে আরও নির্ভরযোগ্য তথ্য পেতে পারেন, যা জন্ডিসের একটি প্রধান কারণ।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ)
১. জন্ডিস হলে কি আমি সাধারণ খাবার খেতে পারব?
জন্ডিস হলে সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। তৈলাক্ত, মশলাদার, ভাজাপোড়া খাবার এড়িয়ে চলুন। ফল, সবজি, নরম ভাত, ডাল এবং কম ফ্যাটযুক্ত প্রোটিন গ্রহণ করা ভালো।
২. জন্ডিস হলে কি হলুদ ফল খাওয়া যাবে?
সবুজ বা হলুদ ফল (যেমন – আম, পেঁপে, কলা) জন্ডিসের সময় খাওয়া যায়, যদি তা সহজে হজম হয়। তবে, অতিরিক্ত মিষ্টিযুক্ত ফল বা যেগুলি হজমে সমস্যা তৈরি করে, সেগুলো এড়িয়ে চলা ভালো।
৩. জন্ডিস নিরাময়ে কত দিন সময় লাগে?
জন্ডিসের কারণ, তীব্রতা এবং রোগীর সামগ্রিক স্বাস্থ্যের উপর নির্ভর করে এটি সেরে উঠতে কয়েক দিন থেকে কয়েক মাস পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
৪. জন্ডিস কি ছোঁয়াচে?
জন্ডিস নিজে কোনো রোগ নয়, বরং এটি একটি রোগের লক্ষণ। এটি ছোঁয়াচে কিনা তা নির্ভর করে এর কারণের উপর। হেপাটাইটিস এ ও ই ছোঁয়াচে, কিন্তু হেপাটাইটিস বি, সি, ডি সাধারণত রক্ত বা শরীরের তরলের মাধ্যমে ছড়ায়।
৫. জন্ডিস হলে কি প্যারাসিটামল খাওয়া যাবে?
না, জন্ডিস হলে এবং বিশেষ করে লিভারের সমস্যা থাকলে প্যারাসিটামল বা অন্য কোনো ব্যথানাশক ঔষধ চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়। কারণ, প্যারাসিটামল লিভারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
৬. জন্ডিস প্রতিরোধে কি কিছু করা যেতে পারে?
হ্যাঁ, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা, স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া, হেপাটাইটিস বি-এর টিকা নেওয়া এবং মদ্যপান ত্যাগ করার মাধ্যমে জন্ডিসের ঝুঁকি কমানো যায়।
৭. জন্ডিস হলে শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব হতে পারে কি?
কিছু ক্ষেত্রে, লিভারের কার্যকারিতা কমে গেলে ভিটামিন ডি সহ অন্যান্য ফ্যাট-দ্রবণীয় ভিটামিন (A, E, K) শোষণে সমস্যা হতে পারে। তাই, চিকিৎসকের পরামর্শে সাপ্লিমেন্ট নেওয়া লাগতে পারে।
উপসংহার
জন্ডিস একটি সতর্কবার্তা, যা আমাদের শরীরের লিভার সুস্থ রাখার প্রয়োজনীয়তা মনে করিয়ে দেয়। সঠিক সময়ে কারণ নির্ণয় এবং উপযুক্ত চিকিৎসা গ্রহণ করলে এই রোগ থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় লাভ করা সম্ভব। ঔষধ সেবনের পাশাপাশি স্বাস্থ্যকর জীবনধারা, পরিমিত খাদ্য, পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ জন্ডিস নিরাময়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
মনে রাখবেন, প্রতিটি মানুষের শরীর আলাদা এবং জন্ডিসের কারণ ও তীব্রতাও ভিন্ন। তাই, যেকোনো স্বাস্থ্যগত সমস্যার ক্ষেত্রে একজন যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই সবচেয়ে নিরাপদ ও কার্যকর উপায়। আপনার সুস্থতাই আমাদের কাম্য!