লিভার সিরোসিস কি
Last updated on May 26th, 2024 at 10:27 am
লিভার সিরোসিস একটি দীর্ঘস্থায়ী লিভার রোগ, যেখানে লিভার টিস্যু ধীরে ধীরে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায় এবং লিভার কার্যক্ষমতা কমে যায়। এটি সাধারণত লিভারের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির ফলে হয় এবং এটি জীবনের জন্য হুমকিস্বরূপ হতে পারে। লিভার সিরোসিস কি আজকে আমরা এই বিষয়ে জানবো।
Table of Contents
লিভার সিরোসিস কেন হয়?
১) ক্রনিক হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসের সংক্রমণ
২) ফ্যাটি লিভার
৩) মদ্যপানজনিত ফ্যাটি লিভার
৪) ওষুধের পার্শ্বপতিক্রিয়া
৫) উইলসন’স ডিজিজ
৬) হিমোক্রোম্যাটোসিস
৭) সিস্টিক ফাইব্রোসিস ইত্যাদি।
লিভার সিরোসিসের কারণসমূহ
দীর্ঘমেয়াদী অ্যালকোহল সেবন
দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত অ্যালকোহল সেবন লিভারের ক্ষতি করে এবং সিরোসিসের প্রধান কারণ হতে পারে।
ভাইরাল হেপাটাইটিস
হেপাটাইটিস বি এবং সি ভাইরাস সংক্রমণ লিভার সিরোসিসের অন্যতম প্রধান কারণ।
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ
ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, বিশেষ করে নন-অ্যালকোহলিক স্টিয়াটো হেপাটাইটিস (NASH), লিভার সিরোসিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
অন্যান্য কারণ
অন্যান্য কারণগুলির মধ্যে অটোইমিউন ডিজিজ, জেনেটিক ডিজঅর্ডার, এবং বাইল ডাক্ট ডিজিজ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
লিভার সিরোসিসের লক্ষণ ও উপসর্গ
প্রাথমিক লক্ষণ
প্রাথমিক পর্যায়ে লিভার সিরোসিসের লক্ষণগুলি অনেক সময় তেমন দেখা যায় না। তবে কিছু সাধারণ লক্ষণ অন্তর্ভুক্ত করতে পারে:
- ক্লান্তি
- দুর্বলতা
- ওজন কমে যাওয়া
- ক্ষুধামান্দ্য
অগ্রসর পর্যায়ের লক্ষণ
লিভার সিরোসিসের অগ্রসর পর্যায়ে লক্ষণগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে, যেমন:
- জন্ডিস (চামড়া ও চোখের সাদা অংশ হলুদ হয়ে যাওয়া)
- পেটের ফোলা
- পায়ের ফোলা
- চামড়ায় চুলকানি
- রক্তপাত ও ব্রুজিং সহজে হওয়া
জটিলতা
লিভার সিরোসিস বিভিন্ন জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে, যেমন:
- লিভার ক্যান্সার
- লিভার ফেইলিয়র
- হেপাটিক এনসেফালোপ্যাথি
- রক্তপাত ঝুঁকি বৃদ্ধি
লিভার সিরোসিসের নির্ণয় পদ্ধতি
শারীরিক পরীক্ষা
ডাক্তার শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের আকার, জমাট বাঁধা এবং অন্যান্য পরিবর্তন নির্ণয় করতে পারেন।
রক্ত পরীক্ষা
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে লিভারের কার্যক্ষমতা মূল্যায়ন করা হয় এবং সিরোসিসের বিভিন্ন সূচক নির্ণয় করা হয়।
চিত্রায়ণ পরীক্ষা
আল্ট্রাসাউন্ড, সিটি স্ক্যান, এবং এমআরআই এর মাধ্যমে লিভারের বিস্তারিত চিত্রায়ণ করা হয়।
বায়োপসি
লিভারের ক্ষতিগ্রস্ত টিস্যুর নমুনা পরীক্ষা করে সিরোসিসের উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়।
লিভার সিরোসিসের চিকিৎসা
ঔষধি চিকিৎসা
ডাক্তার নির্দিষ্ট ঔষধ প্রয়োগ করে সিরোসিসের কারণ এবং লক্ষণগুলোর চিকিৎসা করে থাকেন।
জীবনধারা পরিবর্তন
অ্যালকোহল সেবন বন্ধ করা, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত ব্যায়াম লিভার সিরোসিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
অস্ত্রোপচার
কিছু ক্ষেত্রে অস্ত্রোপচার প্রয়োজন হতে পারে, যেমন ভ্যারিস রক্তপাত রোধে।
লিভার ট্রান্সপ্লান্ট
গুরুতর ক্ষেত্রে লিভার ট্রান্সপ্লান্টই একমাত্র বিকল্প হতে পারে।
লিভার সিরোসিস হতে পরিত্রাণের উপায়
লিভার হলো আমাদের দেহের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা গৃহীত খাবার বিপাক, প্রসেস, মজুদ করে এবং প্রয়োজনীয় অংশ শরীরের ক্ষয়পূরণ, গঠন, বৃদ্ধি ও চালিকা শক্তিতে কাজে লাগায়; গৃহীত খাবারের সাথে আগত রোগ জীবাণু ধ্বংস করে ; গৃহীত খাবারের সাথে আগত বিভিন্ন রাসায়নিক, বিষাক্ত পদার্থ নির্বিষ করে ; গৃহীত ওষুধ প্রসেস করে দূরবর্তী ক্ষতস্থানে প্রেরণ করে এবং রোগ নিরাময় করে ; দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতায় ব্যাপভিত্তিক ভূমিকা পালন করে ।
লিভার সিরোসিস হলে পরে লিভারের কোষগুলো নষ্ট হয়ে রিজেনারেটিভ নডিউল বা গুটি তৈরি করে যেগুলো পরবর্তীতে ফাইব্রোসিস ও সিরোসিস হয়ে লিভারের স্বাভাবিক মসৃণ আকার আকৃতি নষ্ট হয়ে গিয়ে এবড়ো খেবড়ো কদাকার আকৃতি ধারণ করে এবং লিভারের এসব গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলীর মারাত্মক ব্যাঘাত ঘটে।
লিভার সিরোসিস কি? তাই লিভার সিরোসিস হওয়ার পূর্বেই তা হতে পরিত্রাণে সচেষ্ট থাকাই শ্রেয়।
১) দেহের স্থূলতা কমিয়ে নির্দিষ্ট ওজন বজায় রাখা
২) ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্ত চাপের সঠিক যথোপযুক্ত চিকিৎসা করা এবং নিয়ন্ত্রণে রাখা
৩) প্রত্যহ নিয়মিত শারীরিক ব্যায়াম করা
৪ ) সপ্তাহে দুই দিন রোজা রাখার অভ্যাস তৈরি করা
৫) বাজে তেল, অধিক শর্করা জাতীয় খাবার, ফাস্ট ফুড, প্রসেসড খাবার, এনার্জি ড্রিংকস, স্ট্রিট ফুড, ধূমপান, মদ্যপান, অনিদ্রা, অধিক রাত জাগা ইত্যাদি
বদঅভ্যেস পরিহার করা
৬) নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনের ব্যবস্থা করা
৭) জীবাণুমুক্ত সূঁচ সুতা, সার্জিক্যাল যন্ত্রপাতি, ডেন্টাল যন্ত্রপাতি, বিউটি পার্লারে নাক, কান ফোঁড়ানো বা উল্কি আঁকার কাজে ব্যবহৃত জীবাণুমুক্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রচলন করা
৮) ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক সেবীদের ডিসপোজেবল সিরিঞ্জ ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করা
৯) গর্ভাবস্থায় হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের যথোপযুক্ত চিকিৎসা দেয়া
১০) হেপাটাইটিস বি ভাইরাসে আক্রান্ত মায়ের সন্তান ভূমিষ্ট হওয়ার সাথে সাথেই ১২ ঘন্টার মধ্যে ভ্যাকসিন ও ইমিউনোগোবিউলিন দিয়ে দিতে হবে
১১) আক্রান্ত স্বামী কিংবা স্ত্রী দৈহিক মিলনে কনডম ব্যবহার করবেন এবং অতি সত্বর আক্রান্ত ব্যক্তি চিকিৎসা নিবেন এবং অপরজন আক্রান্ত না হলে টিকা নিয়ে নিবেন
১২) অনৈতিক যৌন মিলনে বিরত থাকতে হবে
১৩) সর্বোচ্চ নৈতিক মানদন্ড সম্পন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হতে হবে এবং ধর্মীয় অনুশীলনগুলো মেনে চলার অভ্যাস তৈরি করতে হবে
১৪) সার্বজনীনভাবে সবার হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের সংক্রমণ রয়েছে কি না তা পরীক্ষার মাধ্যমে জেনে নিতে হবে এবং যার নেই তাকে অবিলম্বে টিকা বা ভ্যাকসিন নিয়ে নিতে হবে
১৫) দীর্ঘ মেয়াদে ব্যথানাশক ওষুধ যেমন Methotrexate গ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষ ও অভিজ্ঞ লিভার বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে নিতে হবে।
লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে করণীয়
অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা
অ্যালকোহল সেবন সীমিত করা লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ।
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস
পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস লিভারের সুস্থতা রক্ষা করে।
নিয়মিত ব্যায়াম
নিয়মিত ব্যায়াম শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে সহায়ক এবং লিভারের সুস্থতা বজায় রাখে।
হেপাটাইটিসের টিকা গ্রহণ
হেপাটাইটিস বি টিকা গ্রহণ হেপাটাইটিস থেকে রক্ষা করে এবং লিভার সিরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক।
উপসংহার
লিভার সিরোসিস একটি গুরুতর এবং দীর্ঘমেয়াদী লিভার রোগ, যার সঠিক চিকিৎসা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন। প্রাথমিক পর্যায়ে সনাক্তকরণ এবং সঠিক চিকিৎসা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এর ঝুঁকি কমানো সম্ভব। স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণ ও সঠিকভাবে চিকিৎসা করা হলে লিভার সিরোসিসের প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
প্রশ্নোত্তর বিভাগ
লিভার সিরোসিস কি পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য?
লিভার সিরোসিস পুরোপুরি নিরাময়যোগ্য নয়, তবে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনধারা পরিবর্তনের মাধ্যমে এর প্রভাব নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
লিভার সিরোসিসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ কোন গোষ্ঠী?
দীর্ঘমেয়াদী অ্যালকোহল সেবনকারী, হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমিত ব্যক্তিরা লিভার সিরোসিসের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ।
লিভার সিরোসিস কি অন্য কাউকে সংক্রমিত করতে পারে?
লিভার সিরোসিস নিজে সংক্রমিত না হলেও এর কিছু কারণ যেমন হেপাটাইটিস বি ও সি ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে।
কি ধরনের খাদ্যাভ্যাস লিভার সিরোসিসের জন্য উপকারী?
স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, যেটিতে প্রচুর শাকসবজি, ফলমূল এবং কম চর্বিযুক্ত প্রোটিন থাকে, লিভার সিরোসিসের জন্য উপকারী।
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কি?
লিভার সিরোসিসের প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে ক্লান্তি, দুর্বলতা, ওজন কমে যাওয়া এবং ক্ষুধামান্দ্য অন্তর্ভুক্ত।
দীর্ঘ মেয়াদী প্রদাহ জনিত (Hepatitis) কারণে লিভারের কোষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে ফাইব্রোটিক টিস্যু এবং একই সাথে গুটি (Regenerating nodules) তৈরি হয়ে লিভারের মসৃণ আকার আকৃতি লোপ পেয়ে এবড়ো খেবড়ো কদাকার আকৃতি ধারণ করা এবং এর কার্যক্ষমতার ব্যাপক হ্রাস পাওয়াই হলো লিভার সিরোসিস। আজকে আমরা লিভার সিরোসিস কি এই বিষয়ে জানবো।